প্রিয় মা, সন্তানের পাশাপাশি নিজেকেও ভালবাসুন

প্রিয় মা, আপনার সন্তানের আপনাকে ভীষণ দরকার কিন্তু আপনার নিজেরও নিজেকে প্রয়োজন। সন্তানের যত্ন নেয়ার সাথে সাথে নিজের খেয়াল রাখতে হবে। নিজেকেও ভালবাসুন, এতে করে সন্তানের আরও ভাল দেখভাল করতে পারবেন। আমার নিজের অভিজ্ঞতা ও  জীবনবোধ থেকে আজকের এই লেখাটি সাজিয়েছি। আশাকরি মায়েরা উপকৃত  হয়ে নিজের যত্ন নিতে  উদ্বুদ্ধ হবেন।

মাতৃত্ব নারীর কাছে এক পরম আকাঙ্ক্ষার বিষয়। সন্তানের মুখ থেকে মা ডাক শোনার অনুভূতির সাথে আর কোন কিছুর ই তুলনা হয়না। গর্ভধারণ থেকে শুরু করে সন্তান লালনপালনে একজন মা কতটা কষ্ট করেন তা লিখে বোঝানোর ক্ষমতা কোন লেখকের নেই।

আমি নিজে দুই কন্যার জননী। আমার মেয়েদের মুখের দিকে তাকালে মাঝে মাঝে মনে হয় আমি এই ধরণীতে সবচেয়ে সুখী। আমার মেয়ে যখন জরিয়ে ধরে মা বলে ডাকে তখন এক অজানা অনুভূতিতে শিউরে উঠে শরীর ও মন। কি তীব্র আবেগ, কি সুন্দর স্পর্শ!!!  

মাতৃত্বের এই চিরন্তন সুন্দর দৃশ্যের আড়ালে কিন্তু খুব মন খারাপ করা বাস্তবতা আছে। আমি নিজে এই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছি, হচ্ছি। সন্তান কে বড় করতে যেয়ে একজন নারীর শরীরের সাথে সাথে মনেও ঝড় বয় কিন্তু সে খবর কজন রাখে?

মাঝে মাঝে কিছুই ভাল্লাগেনা, সব ছেড়ে কোথাও চলে যেতে মন চায়।

সারাদিন বাচ্চার পিছনে চলে যায়, নিজের দিকে তাকানোর  সময় পাই না।

চেহারায় লাবণ্য নেই, চুল পরে যাচ্ছে, আগের জামা ফিট  হয় না, ধুর আর সহ্য হয় না।

বাচ্চাটা সারাদিন কাঁদে, রাতে ঘুমায় না, বড়টা এত বিরক্ত করে যে প্রায়ই গায়ে হাত তুলে ফেলি, তারপর নিজে কাঁদি।

এই ঘটনাগুলো প্রায় সব নারীর জীবনেই ঘটে যখন তারা মা হয়। যে শারীরিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে একজন নারী মা হন তা আমরা সবাই লক্ষ্য করি কিন্তু মানসিক দিক উপেক্ষিত  থাকে। প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতা বলে যে একটা বিষয় আছে সেটা এখনো এদেশের বেশিরভাগ মানুষ জানে না এবং জানতে চায় ও না।

বাচ্চা আস্তে আস্তে বড় হওয়ার সাথে সাথে ডিপ্রেশন অনেকটাই কেটে যায় কিন্তু  নিজের প্রতি অযত্ন আর অবহেলার কারণে ডিপ্রেশনের রেশ রয়ে যায়। রাতের পর রাত নির্ঘুম থাকা, বারবার ডাইপার চেঞ্জ করা, তার খাবারের চিন্তা করা, বাচ্চার অসুখ হলে যখন মার দিকে আঙ্গুল তোলা হয় তখন সেই অপবাদ হজম করা, এরকম হাজারটা পরিস্থিতির ভিড়ে নিজের কথা আর মনে থাকেনা।

এখানেই বেশিরভাগ মায়েরা ভুল করে, আমিও করেছি। সব পরিস্থিতি তে নিজের যত্ন নিতে হবে, নিজেকে ভালবাসতেই হবে। শূন্য কুয়া যেরকম কারো তৃষ্ণা মেটাতে পারেনা ঠিক সেরকম একজন অসুখী ও বিষণ্ণ মানুষ অন্যদের মাঝে সুখ বিলাতে অক্ষম। যে তার নিজের প্রতি অবিচার করছে সে অন্যদের সাথে সুবিচার করবে তা আশা করা যায় না।  

 

 

নিজের প্রতি অযত্ন আর অবহেলার পরিণতি হতে পারে রুগ্ন স্বাস্থ্য ও ভঙ্গুর মন। মানসিক অশান্তি ও স্ট্রেস থাকলে তা অনেক সময় দাম্পত্য কলহের কারণ হতে পারে। নিজে অসুখী থেকে সংসারে মন দেয়া কঠিন হয়ে যায়। ঘরের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ না হলে তার বিরূপ প্রভাব পরে বাচ্চাদের উপর। 

আমরা সব মা রাই সন্তানের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করি আর তাদের সর্বোত্তম মঙ্গল কামনা করি। মা হিসেবে সন্তানের জন্য নিজেকে উজাড় করে দেয়াটাই স্বাভাবিক কিন্তু মাতৃত্বের আড়ালে আপনার নিজের স্বকীয়তা বিলীন হতে দেয়া মোটেও বাঞ্ছনীয় নয়। সন্তান আস্তে আস্তে বড় হবে। তার নিজস্ব জগত হবে, তার আপন ভুবনে সেই হবে একচ্ছত্র অধিকারী, এটাই পৃথিবীর নিয়ম। সন্তান এর পিছনে যদি আপনার সব টা দিতে গিয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলেন তাহলে আপনার মধ্যে যে শূন্যতা তৈরি হবে তা কোনদিন পূরণ হবার নয়।

সন্তানকে সময় দিন, তার সঠিক বেড়ে ওঠা ও বিকাশ নিশ্চিত করতে যা যা করণীয় তার সবটাই করুন।পাশাপাশি এটা মাথায় রাখবেন, আপনার সন্তানের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা ও সার্বিক কল্যাণের জন্য আপনার সুস্থ থাকা জরুরি। শুধু শরীরের যত্ন নিলে হবেনা, মন কেও আনন্দ দিতে হবে। 

পৃথিবীর সব মায়েরা ভালো থাকুক, তাদের সন্তানের মাথার ওপর ছায়া হয়ে বেঁচে থাকুক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *