মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতাঃ মনের অসুখ নিয়ে ভাবার সময় এখনই

বাংলাদেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠী মানসিক অসুস্থতায় ভুগছে এবং মানসিক ভাবে বিকলাঙ্গ লোকের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। সাম্প্রতিক কালের কিছু ঘটনা তার সাক্ষী। সন্তান কর্তৃক পিতা-মাতার খুন অথবা পিতার হাতে পুত্রের প্রাণনাশ এটাই প্রমাণ করে যে এক ভয়াবহ মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে আমাদের সমাজ এগিয়ে চলছে। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এখন আর উদাসীন থাকার সুযোগ নেই। মানসিক স্বাস্থ্যের নির্ধারক ও মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ ও উপসর্গ নিয়ে আজকের লেখাটি সাজানো হয়েছে।

ইদানীং পত্রিকা হাতে নিলেই সব বীভৎস ঘটনা চোখে পড়ে। একদল মানুষ কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলছে, বাবার হাতে মেয়ে ধর্ষিত হয়, ঘুমন্ত শিশুকে জবাই করে নির্মম কায়দায় হত্যা করেছে তারই আপন পিতা, মা শিশুকে খুন করছে, পুত্র পিতাকে ছুরিকাঘাত করছে ইত্যাদি।

মানসিক ভাবে সুস্থ কোন মানুষ কি তার নিজ সন্তানকে জবাই করতে পারে? কতটা বিকারগ্রস্ত হলে কাউকে পিটিয়ে লাশ বানানো যায়? কতটা বিকলাঙ্গতা থাকলে কেউ ৯ মাসের শিশুকে রেপ করে? কতটা হতাশা থাকলে নিজেকে শেষ করাই একমাত্র সমাধান মনে হয়?

উত্তর মেলানো কঠিন। আমাদের দেশে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা নেই বললেই চলে। এত বিশাল জনসংখ্যার দেশে মানসিক রোগের সেবা দেয়ার জন্য বিশেষজ্ঞের পরিমাণ খুব ই নগণ্য। শরীরের অসুখ কে যে গুরুত্ব দেয়া হয় তার সিকি ভাগ ও যদি মানসিক অসুস্থতাকে দেয়া হত তাহলে আজ সমাজের চিত্র অন্যরকম হত।

আমরা আসলে কতটুকু সচেতন আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে? National Institute of Mental Health and Research (NIMH&R) এর এক গবেষণায় দেখা যায় বাংলাদেশে মানসিক অসুস্থতায় আক্রান্ত ব্যাক্তির সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি। এটি ২০১৬ সালের কথা, এখন হয়ত সংখ্যাটা আরও বেশি।

মানসিক স্বাস্থ্য বলতে কি বুঝায়?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা WHO এর সংজ্ঞানুযায়ী “Mental health is defined as a state of well-being in which every individual realizes his or her own potential, can cope with the normal stresses of life, can work productively and fruitfully, and is able to make a contribution to her or his community.”

মানসিক স্বাস্থ্য শুধু মাত্র মানসিক রোগ না থাকাই নয়। মানসিক স্বাস্থ্য বলতে এমন অবস্থা বোঝায় যেখানে একজন মানুষ তার নিজের সম্ভাবনা বুঝতে পারবেন, নিজের দৈনন্দিন জীবনের স্ট্রেস মোকাবেলা করতে পারবেন এবং নিজের জন্য, সমাজের জন্য উৎপাদনশীল কাজে যুক্ত থাকতে পারবেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বাস্থ্যের সংজ্ঞা দিয়েছে পরিষ্কার ভাবে মানসিক স্বাস্থ্যকে সংযুক্ত করেই এবং এটা উল্লেখ করেছে মানসিক স্বাস্থ্য ব্যতিরেকে কোনও স্বাস্থ্য নেই।

 

আমরা কতটুকু ভাবছি নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে? অনেকের পরিবারেই এরকম কেউ না কেউ আছেন যার আচরণ স্বাভাবিক নয়, যে হয়ত মানসিক ভাবে সুস্থ নয়, কিন্তু আমরা কি তাকে নিয়ে কোন মনঃচিকিৎসকের কাছে গিয়েছি? শরীরের অসুখে যতটা বিচলিত হন, মনের অসুখ নিয়ে কি কখনো ভাবেন?

মানসিক স্বাস্থ্যের নির্ধারক

স্তর

ক্ষতিকর উপাদান

প্রতিরক্ষামূলক উপাদান

ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যাবলী

আত্মসম্মানবোধ এর ঘাটতি

আবেগীয় অপরিপক্কতা

যোগাযোগের অক্ষমতা

শারীরিক অসুস্থতা ও মাদকাসক্তি

আত্মসম্মানবোধ ও আত্নবিশ্বাস

সমস্যা সমাধানের সক্ষমতা

যোগাযোগের দক্ষতা

শারীরিক সুস্থতা ও ফিটনেস

সামাজিক অবস্থা

সল্প আয় ও দারিদ্র্য

একাকীত্ব ও প্রিয়জনের মৃত্যু

অবহেলা ও পারিবারিক কোন্দল

কাজের চাপ, বেকারত্ব

সহিংসতার শিকার

শিক্ষাজীবনে সফল হতে না পারা

অর্থনৈতিক সচ্ছলতা

পরিবার ও বন্ধুদের সমর্থন

সুখি পারিবারিক জীবন

কর্মক্ষেত্রে সাফল্য

শারীরিক নিরাপত্তা ও সুরক্ষা

সাফল্যমণ্ডিত শিক্ষাজীবন

 পরিবেশগত উপাদান

প্রয়োজনীয় মৌলিক চাহিদা পুরন না হওয়া

সামাজিক ও লৈঙ্গিক অসমতা

অবিচার ও বৈষম্য

যুদ্ধ ও দুর্যোগের প্রভাব

মৌলিক অধিকার লাভের সমতা

সামাজিক ও লৈঙ্গিক সমতা

সামাজিক ন্যায়বিচার, সহিষ্ণুতা ওএকীকরণ

শারীরিক / সামাজিক নিরাপত্তা ও সুরক্ষা

[সুত্রঃ World Health Organization]

মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ ও উপসর্গ

রোগের মাত্রা, পরিবেশ-পরিস্থিতি ও অন্যান্য উপাদানের উপর ভিত্তি করে মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ ও উপসর্গ ক্ষেত্র বিশেষে ভিন্নভাবে পরিলক্ষিত হয়। কিছু সাধারণ উপসর্গ হলঃ

দীর্ঘদিন ধরে বিষন্নতায় ভোগা
প্রবল দুঃখবোধ
মনোযোগ এর অসুবিধা
অতিরিক্ত রাগ খিটখিটে মেজাজ
সব সময় ক্লান্তি বোধ করা
ঘুমের অসুবিধা
বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া

 

ঘন ঘন মুড সুইং
মাত্রাতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করা
বাস্তবতা থেকে দূরে সরে যাওয়া
প্রাত্যহিক জীবনের ছোটখাটো সমস্যা সমাধান করতে না পারা
মানুষের সাথে মিশতে অসুবিধা হওয়া
খাদ্যাভ্যাসে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা
আত্মহত্যা বা নিজেকে শেষ করে দেয়ার প্রবণতা

[সুত্রঃ https://www.mayoclinic.org/]

 

উপরে উল্লেখিত এক বা একাধিক লক্ষণ উপসর্গ কারো মধ্যে লক্ষ্য করা গেলে বুঝতে হবে যে সেই ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে। এরকম ক্ষেত্রে অবশ্যই কোন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া উচিত। যথাসময়ে ব্যবস্থা নিলে মানসিক অসুস্থতা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *